১৯৭০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপএটি ফিফা কর্তৃক আয়োজিত পুরুষ জাতীয় দলের নবম বিশ্বকাপ। এই বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ ছিলো মেক্সিকো। ১৯৭০ সালের ৩১ মে থেকে ২১ জুন পর্যন্ত এটি সম্পন্ন হয়। এই বিশ্বকাপটি ইউরোপ এবং দক্ষিন আমেরিকার বাইরে আয়োজিত পথম টুর্নামেন্ট। উত্তর আমেরিকাতেও আয়োজিত পথম বিশ্বকাপ ছিলো এটি। ১৬ টি দেশ নিয়ে এই বিশ্বকাপের মূল পর্বের খেলা হয়েছিলো। মেক্সিকোর ৫ টি শহরে খেলাগুলো সম্পন্ন হয়েছিলো। মোট ৩২ ম্যাচ খেলা হয়েছিলো। টুর্নামেন্টে মোট ৯৫ ( ম্যাচ প্রতি গড় ২.৮৭ ) টি গোল হয়। টুর্নামেন্টে মোট দর্শক ছিলো ১,৬০৪,০৬৫ ( ম্যাচ প্রতি গড় ৫০,১২৭ ) জন। শীর্ষ স্কোরার হন জার্মানির গার্ড মুলার ( ১০ গোল )। সেরা তরুণ খেলোয়াড় হন তেওফিলো ( পেরু )। ফেয়ার প্লে পরস্কার লাভ করে পেরু। এই বিশ্বকাপে ব্রাজিল তাদের ৩য় শিরোপা অর্জন করেন। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপে সেটেলাইটের উন্নতির ফলে রেকর্ড পরিমান টেলিভিশন দর্শক আকর্ষণ করেছিলো।
স্বাগতিক দেশ নির্বাচন
১৯৬৪ সালের ৪ অক্টোবর ফিফা কংগ্রেসের ভোটে আয়োজক দেশ হিসাবে মেক্সিকোকে নির্বাচিত হয়েছিলো। এই স্বাগতিক নির্বাচনে বেশ কিছু পার্থক্য লক্ষ করা যায়। যেমন আমেরিকা ও দক্ষিণ ইউরোপের বাইরে এবং উত্তর আমেরিকায় প্রথম বিশ্বকাপ ছিলো এটি।
যোগ্যতা অর্জন
এই বিশ্বকাপে রেকর্ড পরিমান ৭৫ টি (প্রত্যাখ্যান এবং প্রত্যাহারের পর ৬৮ টি ) দলকে নিয়ে বাছায় পর্ব খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।
ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড এবং স্বাগতিক মেক্সিকো অটোমেটিক মূল পর্বে জায়গা পায়। বাকি ১৪ টি দলকে বিভিন্ন মহাদেশ ভিত্তিক কনফেডারেশনের মধ্যে নির্বাচনের জন্য ভাগ করে দেওয়া হয়। ৮ টি ইউরোপ (UEFA), তিনটি দক্ষিণ আমেরিকা(CONMEBOL), একটি আফ্রিকা (CAF), একটি এশিয়া/ ওশেনিয়া থেকে (AFC/OFC), আর একটি CONCACAF এর জন্য উপলব্ধ ছিলো।
১৯৬৮ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি বাছায় পর্বের জন্য ড্র হয়েছিলো।
এখন পর্যন্ত এটিই একমাত্র বিশ্বকাপ ছিলো যেখানে ইসরাইল বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিলো এবং আর্জেন্টিনা যোগ্যতা করতে পারেনি।
মূল পর্বে জায়গা পওয়া দলের তালিকা
বাছাইপর্ব থেকে ১৪ টি, ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড এবং স্বাগতিক মেক্সিকোকে (মোট ১৬ টি) নিয়ে মূল পর্ব সাজানো হয়:-
- ইজরায়েল
- এল সালভাদর
- মেক্সিকো (মেক্সিকো)
- পেরু
- ব্রাজিল
- উরুগুয়ে
- চেকোস্লোভাকিয়া
- ইংল্যান্ড ( ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন)
- বুলগেরিয়া
- ইতালি
- বেলজিয়াম
- পশ্চিম জার্মানি
- সোভিয়েত ইউনিয়ন
- রোমানিয়া
- সুইডেন
- মরক্কো
খেলার বিন্যাস
মূল পর্বে চান্স পাওয়া মোট ১৬ টি দলকে চারটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। গ্রুপের প্রতিটি দলকে একে অপরের সাথে খেলতে হবে। একটি জয়ের জন্য দইটি এবং একটি ড্রয়ের জন্য একটি পয়েন্ট দেওয়া হয়। দইটি দলের পয়েন্ট সমান হলে গোলের গড় হিসাব করা হবে। প্রতিটা গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন এবং রানার্সআপকে নকআউট পর্বে খেলার যোগ্যতা দেওয়া হয়।
মূল পর্বের খেলা
১ম গ্রুপ
এই গ্রুপে মেক্সিকো, সোভিয়েত, এল সালভাদর এবং বেলজিয়াম ছিলো। গ্রুপ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মেক্সিকো সমান ৫ পয়েন্ট নিয়ে নকআউট পর্বে চলে যায়।
২য় গ্রুপ
উরুগুয়ে, ইতালি, ইজরায়েল এবং সুইডেন এই গ্রুপে নিজেদের মধ্যে লড়াই করে। এই গ্রুপের ইতালি ৪ পয়েন্ট এবং উরুগুয়ে ৩ পয়েন্ট নিয়ে পরবর্তী রাউন্ডে জায়গা করে নেয়।
৩য় গ্রুপ
ইংল্যান্ড, রোমানিয়া, চেকোস্লেভাকিয়া এবং ব্রাজিল এই গ্রুপে অংশগ্রহণ করে। এই গ্রুপ থেকে ব্রাজিল সর্বোচ্চ ৬ পয়েন্ট নিয়ে এবং ইংল্যান্ড ৪ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় হয়ে নকআউট পর্বে উঠে।
৪র্থ গ্রুপ
এই গ্রুপে মরক্কো, পেরু, পশ্চিম জার্মানি এবং বুলগেরিয়া নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে। জার্মানি সর্বোচ্চ ৬ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে এবং পেরু ৪ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ রানার্সআপ হয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যায়।
নকআউট পর্ব
যে আটটি দল গ্রুপ পর্ব থেকে এই পর্বে তাদের নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক পর্ব শুরু হয়। নকআউটে ( ফািইনাল ব্যতিত) পর্বে ৯০ মিনিটের খেলায় ড্র হলে অতিরিক্ত ১৫ মিনিট খেলা হতো। অতিরিক্ত মিনিটেও যদি খেলা ড্র হয় তাহলে রেফারি কয়েন দ্বারা টস করে বিজয়ী নির্ধারন করবে। ফাইনাল ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ের পরও যদি ড্র হয় তাহলে খেলা পরের তারিখে পুনরায় হবে।
কোয়ার্টার ফাইনাল
সোভিয়েত ইউনিয়ন, মেক্সিকো, ইতালি, উরুগুয়ে, ব্রাজিল, ইংল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানি এবং পেরু এই ৮টি দল নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এই পর্বের ম্যাচগুলো নিচে দেওয়া হলো:-
১ম ম্যাচে উরুগুয়ে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন মুখোমুখি হয় । উরুগুয়ে ১-০ গোলে সোভিয়েত ইউনিয়নকে হারিয়ে সেমিফািইনালে উঠে যায়।
২য় ম্যাচে ব্রাজিল ৪-২ গোলে পেরুকে হারায়। পেরু এই বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়।
৩য় ম্যাচে ৪-১ গোলে ইতালি মেক্সিকোকে হারিয়ে সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।
৪র্থ ম্যাচে পশ্চিম জার্মানি ৩-২ গোলে ইংল্যান্ডকে পরাজিত করে পরবর্তী রাউন্ডে চলে যায়।
সেমিফাইনাল খেলা
কোয়ার্টার ফাইনালে জয়লাভ করা ৪ ( ব্রাজিল, উরুগুয়ে, পশ্চিম জার্মানি এবং ইতালি) দল নিয়ে সেমিফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হয়।
১ম ম্যাচে ৩-১ গোলে উরুগুয়ে ব্রাজিলের কাছে পরাজিত হয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় গ্রহণ করে এবং ব্রাজিল আরো একবার ফাইনালে জায়গা করে নেয়। এই ম্যাচের দর্শক সংখ্যা ছিলো ৫১,২৬১ জন।
২য় ম্যাচে মুখোমুখি হয় ইতালি এবং পশ্চিম জার্মানি। ইতালি ৪-৩ গোলে ম্যাটি জিতে ফাইনালে উঠে। ৯০ মিনিটের খেলায় ১-১ গোলে ড্র হলে অতিরিক্ত সময়ের খেলা হয়। এই ম্যাচ দর্শক ছিলো ১০২,৪৪৪ জন। পশ্চিম জার্মানির হয়ে জোড়া গোল করেন মুলার।
৩য় ও ৪র্থ স্থান নির্ধারণী ম্যাচ
সেমিফাইনালে পরাজিত উরুগুয়ে এবং পশ্চিম জার্মানি এই খেলায় মুখোমুখি হয়। উরুগুয়ে ০-১ গোলে পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে যায়। পশ্চিম জার্মানি ৩য় হয় এবং উরুগুয়ে ৪র্থ হয়।
ফাইনাল ম্যাচ
মেক্সিকো সিটিতে ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালটি অনুষ্ঠিত হয়। ফাইনালে ব্রাজিল ৪-১ গোলের বড় জয় পায়। ব্রাজিলের হয়ে একটি করে গোল করেন পেলে, গেরসন, জাইরজিনহো এবং কার্লোস আলবার্তো। অপর দিকে ইতালির হয়ে একমাত্র গোল করেন বোনিনসেগনা। ব্রাজিল তাদের তৃতীয় বিশ্বকাপ অর্জন করে এবং ইতালি হয় রানার্সআপ। ফাইনালে দর্শক ছিলো ১০৭,৪২১ জন।এই ম্যাচের রেফারির দায়িত্তপালন করেন রুডি গ্লোকনার ( পূর্ব জার্মানি)।